কুলাউড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে এখন যেন উন্নয়নের নতুন চিত্র আঁকা হচ্ছে। বিশেষ করে নারীদের জীবনযাত্রায় এসেছে অভূতপূর্ব পরিবর্তন। আগে যারা শুধুই সংসারকেন্দ্রিক ছিলেন, আজ তারাই কৃষিকাজ, হাঁস-মুরগি পালন, সবজি উৎপাদন ও খামারি পরিচালনার মাধ্যমে হয়ে উঠেছেন আত্মনির্ভর। এই বদলে যাওয়ার পেছনে রয়েছে ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের (SFDF) বাস্তবায়নাধীন এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (IMED) পরিচালিত প্রকল্প ‘দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্র সংযোগ যৌথ প্রকল্প’।

এই প্রকল্পের আওতায় সদস্যদের শুধু অর্থনৈতিক ঋণ দেওয়া হচ্ছে না, বরং দেওয়া হচ্ছে জীবন পরিবর্তনের দীক্ষা। স্বল্পসুদে দুই লক্ষ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ ঋণ, কৃষিজ প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং পণ্য বিপণনের জ্ঞান দিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে একেকজন নারী উদ্যোক্তা।

এই প্রকল্পে যুক্ত ২৫ জন সদস্যের সম্মিলিত সঞ্চয় জমা হয়েছে ৫,০৫,১১৩ টাকা এবং মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০,০৯,৪৬৫ টাকা। তাদের মধ্যে অনেকে এখন মাসে ৪০-৫০ হাজার টাকার মতো আয় করছেন।
এই প্রকল্পের আওতায় সম্প্রতি আয়োজিত হয় “আয়বর্ধনমূলক কার্যক্রম ব্যবস্থাপনা ও উদ্বুদ্ধকরণ প্রশিক্ষণ”। এই প্রশিক্ষণে প্রধান অতিথি ছিলেন মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কুলাউড়া। প্রশিক্ষক ছিলেন মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন, অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা এবং সভাপতিত্ব করেন প্রশান্ত কুমার লোধ, সহযোগী সমন্বয়কারী (ফসল, পোল্ট্রি, মৎস্য, ডেইরি)। প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেন মোহাম্মদ শাহাবুল ইসলাম, উপজেলা ব্যবস্থাপক, SFDF।

প্রশিক্ষণ অংশগ্রহণকারীরা জানান, এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারা কেবল চাষাবাদই নয়, বরং অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত, উৎপাদন পরিকল্পনা ও বাজার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান অর্জন করেছেন। তারা নিজেরাই এখন মনে করেন—“আমরা আর গরীব নই, আমরা উদ্যোক্তা।”

অন্যদিকে, ৩ আগস্ট ২০২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় প্রকল্পের কার্যক্রম পরিদর্শন ও মতবিনিময় সভা। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন মোহাম্মদ শাহাদত হোসেন, সদস্য, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কমিটি (IMED), পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। উপস্থিত ছিলেন উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা, স্থানীয় কৃষক প্রতিনিধি, প্রকল্পের সুফলভোগী সদস্যবৃন্দ এবং উপজেলা ব্যবস্থাপক (SFDF) মোঃ শাহাবুল ইসলাম।
সভায় বক্তারা তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তারা বলেন, এ প্রকল্পের মাধ্যমে তারা গরু কিনে দুধ বিক্রি করছেন, হাঁস-মুরগি পালন করে আয় করছেন, সবজি চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তবে তারা আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা উত্থাপন করেন, যা তারা লিখিত আকারেও জমা দেন।

সদস্যদের প্রস্তাবনার মধ্যে ছিল:
১. ক্ষুদ্র ঋণ =৫০,০০০/- (পঞ্চাশ হাজার) টাকা থেকে শুরু করতে হবে এবং ক্ষুদ্র উদ্যোগ ঋণ =১,৫০,০০০/- (এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা) থেকে শুরু করার জন্য উল্লেখ করেন।
২. সুদের হার ১১% পরিবর্তন ৯% করার জন্য উল্লেখ করেন।
৩. মহিলা সদস্যদের ক্ষেত্রে তাদের স্বামী মারা গেলে ঋণ মওকুফ করার জন্য উল্লেখ করেন।
৪. ক্ষুদ্র উদ্যোগ ঋণ গ্রহণকারী সদস্য মারা গেলে সেই ঋণ মওকুফ করার জন্য উল্লেখ করেন।
৫. ঋণ গ্রহণের সময় ঝুঁকির মূল্যায়ন হার ১.৫% এর কম নেওয়ার জন্য উল্লেখ করেন।
৬. প্রাপ্ত নীট তহবিল বৃদ্ধির ব্যবস্থা দ্রুত করার জন্য জোর দাবি করেন।
পরিবারভিত্তিক সদস্যগণ প্রতিমাসে দেন তাদের বিনিয়োগকৃত সঞ্চয় প্রতি মাসে সর্বনিম্ন (৬০০-৭০০) টাকা জমা করেন।

প্রধান অতিথি মোহাম্মদ শাহাদত হোসেন তাদের প্রস্তাব শোনার পর বলেন, “আপনাদের অভিজ্ঞতা এবং বাস্তব সমস্যা সরকারকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় সহায়ক হবে। আমরা চাই—বাংলাদেশ নিজের চাহিদা পূরণ করে একসময় রপ্তানিমুখী কৃষি অর্থনীতির দেশে পরিণত হোক।”
এই সভা এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে দেখা গেছে, সুফলভোগী নারীদের আত্মবিশ্বাস এখন অনেক বেশি। তাহেরা বেগম বলেন, “প্রথমে ভেবেছিলাম আমি পারবো না। কিন্তু আজ আমি প্রতি মাসে লাখ টাকা ছুঁই। আমার ক্ষেতের লাউ, টমেটো, বেগুন এখন বাজারে যায়। আমার সন্তান স্কুলে যায়, আর আমি নিজের টাকা দিয়েই সংসার চালাই।”

এ ধরনের প্রকল্প কেবল আর্থিক সাহায্য নয়—বরং এটি নারীর সম্মান, মর্যাদা ও ক্ষমতায়নের পথে এক মাইলফলক। কুলাউড়ার অভিজ্ঞতা বলে দেয়, যদি সুযোগ দেওয়া হয়, প্রশিক্ষণ ও সহায়তা থাকে—তাহলে গ্রামের নারীরাও হতে পারেন দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি।

সরকার যদি এমন প্রকল্পগুলো আরও বিস্তৃতভাবে বাস্তবায়ন করে, তাহলে তাহেরা বেগমের মতো হাজার হাজার নারী বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে পারবেন আরও সাহসের সঙ্গে।